নিজস্ব প্রতিবেদক. বাগেরহাট.প্রতি বছরের মতো এবারও শুরু হয়েছে সুন্দরবনের দুবলার চরের শুঁটকির মৌসুম। জীবন জীবীকার তাগিদে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছেন উপকূলের হাজারো জেলে। দস্যু আতংক ও কাঁধে ঋণের বোঝা, সামনে ৫মাসের অনিশ্চিত জীবন। কেউ স্বর্ণ বন্ধক রেখে, কেউ চড়া সুদে টাকা নিয়ে সাগরের পথে।
শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) রাত থেকে শুরু হচ্ছে তাদের দুবলার চরে শুঁটকি মৌসুমের যাত্রা। জীবনের ঝুঁকি আর মহাজনের দেনা মাথায় নিয়েই নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় পাড়ি দিচ্ছেন তারা।
দুবলার চর বাংলাদেশের অংশে সুন্দরবনের দক্ষিণে, কটকার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি দ্বীপ, যা হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পূণ্যস্নান, রাসমেলা ও হরিণের জন্য বহুল পরিচিত। কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে এটি একটি বিচ্ছিন্ন চর। এই চরের মোট আয়তন প্রায় ৮১ বর্গমাইল। আলোরকোল, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকেল্লা, অফিসকেল্লা, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া এবং মেহের আলির চর নিয়ে দুবলার চর গঠিত।
দুবলার চরে তৈরি হয় জেলে পল্লী। সাগরে মাছ ধরার সঙ্গে চলে শুঁটকি শোকানোর কাজ। বর্ষা মৌসুমের ইলিশ শিকারের পর হাজারো জেলে পাঁচ–সাড়ে পাঁচ মাসের জন্য সুদূর কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা ও সাতক্ষীরা থেকে ডেরা বেঁধে সাময়িক বসতি গড়ে সেখানে। মেহের আলির খাল, আলোরকোল, মাঝেরচর, অফিসকেল্লা, নারকেলবাড়িয়া, মানিকখালী, ছাফরাখালী ও শ্যালারচর এলাকায় জেলেপল্লী স্থাপিত হয়। এই ক’মাস তারা মাছকে শুঁটকি বানাতে ব্যস্ত থাকেন। এখান থেকে শুঁটকি পাইকারি বাজারে মজুদ ও বিক্রি করা হয়।
সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগ থেকে মাছ সংগ্রহের অনুমতি সাপেক্ষে বহরদার ও জেলেরা দুবলার চরে প্রবেশ করে থাকেন। দুবলার চর থেকে সরকার নিয়মিত হারে রাজস্ব পেয়ে থাকে। প্রতি বছর বিএলসি (বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট), ডিএফসি (ডেইলি ফুয়েল কনজাম্পশন) ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় বন বিভাগকে রাজস্ব প্রদান করে মৎস্য ব্যবসায়ীগণ সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি পান। এছাড়া আহরিত শুঁটকি মাছ পরিমাপ করে নিয়ে ফিরে আসার সময় মাছভেদে নির্ধারিত রাজস্ব প্রদান করতে হয়।শুধুমাত্র সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে ও নানা প্রতিকূলতায় ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে পারেননি জেলে পরিবারগুলো। বরং দিন দিন তাদের অবস্থার অবনতি ঘটেছে। ক্রমবর্ধমান ক্ষতির মুখে ইতোমধ্যে পুঁজি ও জাল-নৌকা হারিয়ে পেশা হারিয়েছেন অনেকে। জেলেরা বলছেন, মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিতে হয়। কেউবা টাকা নিচ্ছেন এনজিও, বিভিন্ন ব্যাংক ও সমিতি থেকে ঋণ হিসেবে। ঋণ ও সুদের বোঝার সঙ্গে এমন দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই পাঁচ মাসের এক অনিশ্চিত জীবন শুরু করতে চলেছেন তারা।
ডুমুরিয়া এলাকার বহদ্দার রবিন বিশ্বাস বলেন, প্রতি বছর আমরা বিভিন্নভাবে ঋণ করে সমুদ্রে যাই। এবছরও পাঁচ লাখ টাকা ঋণ করেই সাগরে যাচ্ছি। সরকারিভাবে আমরা তেমন কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাই না।
তিনি আরও বলেন, “সুন্দরবনে জলদস্যু-বনদস্যুর উৎপাত ও মুক্তিপণ আদায়সহ অসাধু বনরক্ষীদের দৌরাত্ম্য দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। তবে বর্তমানে জলদস্যু-বনদস্যুর উৎপাত আবারও বেড়েছে।
একই এলাকার জেলে দ্বীপক মল্লিক বলেন, “বনবিভাগের পাস নিয়েই আমরা রওনা হই সাগরপাড়ের দুবলার চরে। ধার-দেনা করেই আমাদের যেতে হয় সাগরে। তবে অনেকে এবার সুদে টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় স্বর্ণের জিনিস রেখে টাকা আনতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন সাগরে দস্যুদের উৎপাত না থাকলেও এবার নাকি দস্যুদের দেখা যাচ্ছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানী ও ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি মাথায় নিয়েই দুবলায় যাত্রা শুরু করি আমরা হাজার হাজার জেলে।
জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির মোংলা শাখার সভাপতি বিদ্যুৎ মণ্ডল বলেন, “পাস-পরমিট হাতে পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর সকল জেলেরা দুবলার চরের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। তারা এখান থেকে সব ধরনের সরঞ্জাম নিয়েই যাবেন।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম বলেন, বনবিভাগের কাছ থেকে পাস (অনুমতিপত্র) নিয়ে নিজ নিজ এলাকা থেকে রওনা হয়ে জেলেদের সরাসরি যেতে হবে দুবলার চরে। চরে ঘরবাড়ি বা দোকানপাট তৈরির জন্য সুন্দরবনের কোনো গাছ কাটা যাবে না। এছাড়া বনদস্যু দমনে কোস্টগার্ডসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, গত শুঁটকি মৌসুমে দুবলার চর থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছিল সাড়ে ৬ কোটির মতো। এবারও সাড়ে ৬ থেকে ৭ কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায়ের আশা করছি।