নিজেস্ব প্রতিনিধি, ২৬ বছরের তরুণ রবিউল ইসলাম এখন শুধু বেঁচে থাকার লড়াই করছে। একসময় হাসিখুশি, পরিশ্রমী আর মসজিদপ্রেমী এই তরুণ আজ শয্যাশায়ী। ক্যান্সারের যন্ত্রণায় দিন কাটছে তার, রাতগুলো পেরোয় কান্নায়। একসময় যিনি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, দোকানে কাজ করে সংসার চালাতেন আজ তিনি চলতে পারেন না, উঠতে পারেন না, এমনকি মসজিদেও যেতে পারেন না।
রবিউল বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার আন্ধারমানিক এলাকার আওয়াল শেখ ও নেহার বেগম দম্পতির সন্তান। তিন ভাইবোনের মধ্যে মেঝ তিনি। ছোটবেলায় সংসারের অভাবে লেখাপড়া থেমে যায়। নয় বছর বয়সে বড় খালার বাড়ি নরেন্দ্রপুর গ্রামে চলে আসেন জীবিকার খোঁজে। তখন থেকেই কাজের জীবন শুরু একটি হার্ডওয়্যার দোকানে কর্মচারী হিসেবে দিন কাটাতে থাকেন সে।

সেই ছোটবেলা থেকেই রবিউলের একটাই স্বপ্ন ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানো, পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো। কিন্তু ভাগ্য যেন এক নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছে তার সঙ্গে।
রবিউল বলেন, ২০২২ সালে পিঠে ছোট একটা ফুসকুড়ির মতো টিউমার উঠেছিল। ভাবছিলাম, ছোট কিছু হবে, নিজে নিজে সেরে যাবে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটি বড় হতে থাকে। পরে ২০২৩ সালে অপারেশন করলাম, টিউমার কেটে ফেলা হলো।
কিন্তু অপারেশনের কিছুদিন পরই ফের বিপত্তি। একই জায়গায় টিউমার আবার গজিয়ে ওঠে, আগের চেয়ে বড়। অবশেষে ২০২৪ সালের জুন মাসে চিকিৎসকরা জানান, এটি ক্যান্সার।
শরীরের যন্ত্রণা তখনও সহ্য করতাম। কিন্তু এখন তো দাঁড়াতেও পারি না। ডাক্তার বলছে, ঢাকায় নিতে হবে, কেমোথেরাপি লাগবে। কিন্তু এত টাকা আমি কোথায় পাবো? বলতে বলতে থেমে যান রবিউল। চোখ ভিজে ওঠে।
তিনি যোগ করেন, এক মাস ধরে মসজিদেও যেতে পারছি না। নামাজ পড়তে পারি না, যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারি না। মনে হয়, আল্লাহ হয়তো আমাকে ধীরে ধীরে ফিরিয়ে নিচ্ছেন।অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, টিউমারের ওজন ছিল প্রায় সাত থেকে আট কেজি।
ছোট থেকে রবিউলকে লালন-পালন করেছেন তার ভাবী ময়না বেগম। নিজের সন্তান না থাকলেও, রবিউলকেই তিনি সন্তান মনে করেন। রাত হলেই ও কাঁদে। যন্ত্রণায় কাতর হয়। আমরা পাশে বসে থাকি, কিছুই করতে পারি না। ওকে দেখে বুকটা ফেটে যায়। টাকার অভাবে চিকিৎসা বন্ধ। আমি তো নিজের কিছুই দিতে পারি না, আল্লাহ যেন আমার ভাইকে ভিক্ষা দেয়,কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন ময়না বেগম।
তিনি আরও বলেন, ও আমার ছেলের মতো। ছোট থেকে আমি মানুষ করছি। এখন যখন ওর এমন অবস্থা দেখি, মনে হয় আমিও শেষ হয়ে যাচ্ছি। খাওয়ার জন্য আহাজারি করে, কিন্তু খেতে পারে না। শুধু বলে, ভাবী, আল্লাহ আমাকে নিয়ে যান।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রহিম বলেন, রবি খুব ভালো ছেলে। নিয়মিত নামাজ পড়ত, কখনো কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করত না। এখন ক্যান্সারের জন্য একদম নড়াচড়া করতে পারে না। আমরা জানি, ও মসজিদ থেকে চাঁদা তুলে ডাক্তার দেখিয়েছিল। এমন একটা ভালো ছেলের এমন পরিণতি হওয়া কষ্টের।
তিনি বলেন, আমরা এলাকার পক্ষ থেকে চাই, কেউ যেন রবির পাশে দাঁড়ায়। দেশে-বিদেশে যারা সামর্থ্যবান, তারা একটু সাহায্য করলে হয়তো বেঁচে যেতে পারে।
প্রতিবেশী শিউলি বেগমের চোখেও জল। তিনি বলেন, রবি খালার বাড়ি থাকে, কারণ নিজের বাড়িতে তেমন কেউ নেই। খুব শান্ত ছেলে। এখন অসুস্থতার কারণে সারারাত জেগে থাকে, কাঁদে। আমরা পাশের ঘর থেকে শুনতে পাই তার আর্তনাদ। একটা ছেলেকে এভাবে ধীরে ধীরে শেষ হতে দেখা বড় কষ্টের।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. মেহেদী হাসান বলেন, রোগীর অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। টিউমারের জায়গায় সংক্রমণও দেখা দিয়েছে। ঢাকায় নিয়ে উন্্নত চিকিৎসা দেওয়া খুব জরুরি। কেমোথেরাপি শুরু না করলে অবস্থা আরও খারাপ হবে।
শরীরের ক্যান্সারের চেয়ে বড় ক্যান্সার হলো অভাব। রবিউল এখন বিছানায় শুয়ে দিন গোনে। মাঝে মাঝে মসজিদের আজান শুনে চোখে পানি আসে। বলে, আল্লাহ, আমি যদি আবার একটু সুস্থ হতাম, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তাম, কাজ করতাম, কাউকে কষ্ট দিতাম না।
কিন্তু তার পিঠের টিউমার এখন যেন সেই ইচ্ছেগুলোকেও গ্রাস করছে। চিকিৎসা না পেলে তার জীবন যে কোথায় গিয়ে থামবে, তা নিয়ে সবাই শঙ্কিত।
রবিউলের চিকিৎসার জন্য এখনই দরকার সাহায্যের হাত। পরিবারটি এতটাই অসহায় যে হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়ার ভাড়া জোগাড় করাও তাদের জন্য কঠিন। স্থানীয়রা একটি তহবিল গঠনের চেষ্টা করছেন, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।
২৬ বছরের তরুণ রবিউল যে এখনো বাঁচতে চায়, নামাজ পড়তে চায়, হাসতে চায় তার জীবনের আলো যেন নিভে না যায়। সমাজের, দেশের, প্রবাসের যে কেউ যদি এগিয়ে আসে, হয়তো ফিরিয়ে আনা যাবে এক তরুণের হাসি।
এম, এস/